১৬ শতকের মার্কো পোলোর প্রতিকৃতি

মার্কো পোলো ছিলেন একজন ভেনিসীয় পর্যটক এবং বণিক যিনি পশ্চিমাদের মধ্যে সর্বপ্রথম রেশম পথ বা সিল্ক রোড এর অনেকগুলো শাখা অনুসরণ করে পূর্বদিকে বহুদূরে গিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি সর্বপ্রথম ইউরোপীয় হিসেবে মঙ্গোলদের সাম্রাজ্যে পদার্পণকারীদের অন্যতম। তিনি ১২৭১ সালে মাত্র ৬ বছর বয়সে তার পিতা নিকোলো এবং চাচা মাফেও পোলোর সাথে ভ্রমণ শুরু করেন এবং প্রায় ১২৯৫ সালে আবার ফিরে আসেন। তাঁর ভ্রমণ সম্পর্কে তাঁর বইটি তখন সর্বাধিক বিক্রিত হয়েছিল এবং ৭০০ বছর পরেও এটি সুপরিচিত। মার্কো পোলোর ভ্রমণ বৃত্তান্ত বইটি পড়েই ইউরোপের মানুষ চীন, মধ্য এশিয়া সম্পর্কে জানতে পারে।

উইলিয়াম ডালরিম্পল ১৯৮০-এর দশকে এই পথে আবার ভ্রমণ করেছিলেন এবং এটি সম্পর্কে একটি বই লিখেছেন।

মার্কো পোলোর বই

সম্পাদনা

মার্কো পোলো তার ভ্রমণ বই এর জন্য বিখাত যা তিনি তার ফিরে আসার পরে লিখেছিলেন। সেই সময়ে ভেনিস, পিসা এবং জেনোয়া এর মতো বৃহৎ বাণিজ্যিক শহরগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। ভেনিসিয়ান পোলো এবং তার সহ-লেখক, পিসার রাস্টিসিয়ানো, উভয়েই জেনোয়াতে যুদ্ধবন্দী ছিলেন যখন তারা দেখা করেছিলেন এবং বইটি লিখেছিলেন।

মূল শিরোনামটি "এ ডেসক্রিপশন অফ দা ওয়ার্ল্ড" হিসাবে অনুবাদ করে, তবে এটি সাধারণত "দ্য ট্রাভেলস অফ মার্কো পোলো" হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ১৩০০ সালে এটি ছিল পূর্ব দিকে ভ্রমণের প্রথম বিবরণ যা ইউরোপে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং এটির প্রকাশনা থেকে শুরু করে প্রায় ২০০ বছর পরে কেপ রুট দিয়ে পর্তুগিজ ন্যাভিগেটর ভাস্কো দা গামা ভ্রমণের আগ পর্যন্ত এটিতে এশিয়ার সর্বোত্তম বিবরণ উল্লেখ ছিল। পরে পোলোর প্রাচ্যের সম্পদের গল্পগুলো পর্তুগিজদের সমুদ্রযাত্রার কারণের অংশ ছিল এবং কলম্বাস ও এর জন্য উৎসাহিত হয়েছিলেন।

বইটি এশিয়া সম্পর্কে ইউরোপে বেশ কিছু বিষয়ে প্রথমবার উল্লেখ করেছে যা আগে কেউ করেনি; তার মধ্যে রয়েছে - ইরান এর তেল, এবং চীন এর কয়লা, কাগজের টাকা এবং জানালার কাচ সহ আরও বেশ কিছু জিনিসের। কেউ কেউ দাবি করেন যে পোলো ইতালিতে নুডলস প্রবর্তন করেছিল, তবে এটি বেশ বিতর্কিত।

এই ভ্রমণপথটি Project Gutenberg থেকে ডাউনলোড করা বইটির একটি সংস্করণের উপর ভিত্তি করে।

বইটি নিয়ে যথেষ্ট পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিতর্ক রয়েছে। এটি দুটি ইতালীয় দ্বারা লিখিত হয়েছিল, তবে মূলটি সম্ভবত মধ্যযুগীয় ফরাসি ভাষায় ছিল, যা তখনকার বাণিজ্য ভাষা। প্রাচীনতম পরিচিত অনুলিপিগুলো কয়েক দশক পরে বের হয়েছে এবং এগুলো ফরাসি, ইতালীয় এবং ল্যাটিন ভাষায় বেশ কয়েকটি পরস্পরবিরোধী সংস্করণ। পরবর্তী ইতালীয় সংস্করণে দৃশ্যত পোলো পারিবারিক কাগজপত্রের উপর ভিত্তি করে অতিরিক্ত বিষয় যোগ হয়েছে। পোলো আসলে কিছু জিনিস নিজে দেখেছে যা সে বলেছে, আবার অন্য ভ্রমণকারীদের গল্পের পুনরাবৃত্তিও করেছে। কোনটি আসলে কোনটি? রোমান্সের লেখক রাস্টিসিয়ানো গল্পটিকে কতটা অলঙ্কৃত করেছিলেন? কিছু সমালোচক বলেন মার্কো কখনোই কাশগড় এর পূর্ব দিকে যেতে পারেননি এবং শুধুমাত্র মধ্য চীনের গল্প শুনেছেন তিনি কখনই চপস্টিক, চা, বাউন্ড ফিট বা গ্রেট ওয়াল উল্লেখ করেন না। অন্যরা মঙ্গোল ইতিহাস বিবরণ থেকে উদ্ধৃত করে যা ইঙ্গিত করে যে পোলো নামে কেউ প্রকৃতপক্ষে সেখানে ছিল।

সৌভাগ্যবশত, বিভিন্ন পণ্ডিতরা এর বেশিরভাগ বিস্যেই সমাধানে এসেছেন। এখানে, আমরা কেবল ইউল এবং কর্ডিয়ারকে অনুসরণ করি, এবং বিতর্কগুলো উপেক্ষা করে তাদের অনুবাদের মত ভ্রমণপথ নিয়ে আলোচনা করি।

বইটি সাধারণত স্থানগুলোর জন্য ফারসি নাম ব্যবহার করে।

পটভূমি

সম্পাদনা

নিকোলো এবং ম্যাফিও পোলো দুইভাই ভেনিসীয় ব্যবসায়ী ছিলেন। এক ভাইয়ের বাড়িতে স্ত্রী ছিল, কিন্তু তারা প্রধানত একর থেকে কাজ করত (একর একটি শহর যাকে বর্তমানে আক্কো বলা হয় যার উত্তরে ইসরায়েল) এবং কনস্টান্টিনোপল (আধুনিক ইস্তাম্বুল) রয়েছে; যেটি সে সময় ভেনিসের শাসনের তত্ত্বাবধানে ছিল। ১২৬০ থেকে ১২৬৯ পর্যন্ত, ভাইয়েরা সুদূর প্রাচ্যে ভ্রমণ করেছিলেন। তাদের দ্বিতীয় সফরে যা ১২৭১ সালে শুরু হয়, তারা এবার নিকোলোর কিশোর ছেলে মার্কোকে সাথে নেয়।

ডুব্রোভনিক এর কাছে কোরচুলা অ্যাড্রিয়াটিক দ্বীপ যা তখন ভেনিসীয়দের অধিনে ছিল; তাদের সাথে এই পরিবারের ভালো সম্পর্ক ছিল। ধারনা করা হয় যে মার্কো সেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যদিও পরে তিনি প্রধানত ভেনিসে বড় হয়েছেন। কোরচুলা পর্যটন বিকাশের অংশ হিসেবে সেখানে কিছু পোলো-সম্পর্কিত জাদুঘর এবং স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে। অবশ্যই, ভেনিসে এ সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য নিদর্শন আছে।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যখন পোলোরা যাত্রা করেছিল তা নিয়ে ইউল এবং কর্ডিয়ারের ভাষ্য থেকে কিছু উদ্ধৃতি, :

খ্রিস্টধর্ম সেই শঙ্কা থেকে নিজেকে পুনরুদ্ধার করেছিল যার মধ্যে সে ১৪ বছর আগে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল যখন তাতার প্রলয়ের মত খ্রিস্টধর্ম কে গ্রাস করার হুমকি দিয়েছিল। কনস্টান্টিনোপলের দুর্বল ল্যাটিন সিংহাসনটি তখনও দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু তার পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। ক্রুসেডারদের উত্তরসূরিরা এখনও অ্যান্টিওক থেকে জাফা পর্যন্ত সিরিয়ার উপকূল দখল করে রেখেছিল। ইতালির বাণিজ্যিক প্রজাতন্ত্রগুলোর ঈর্ষা প্রতিদিনই বাড়ছিল। আলেকজান্দ্রিয়া তখনও ছিল... ভারতীয় দ্রব্যসামগ্রীর বিশাল বাণিজ্য কেন্দ্র, কিন্তু মঙ্গোল বিজেতারা যে সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছিল, যারা এখন পারস্য উপসাগর থেকে কাস্পিয়ান এবং কৃষ্ণ সাগরের উপকূল পর্যন্ত সমগ্র ভূখণ্ড দখল করে রেখেছিল,তারা কাফেলার ভ্রমণ পথের যাত্রীদের বড় সুবিধা দিচ্ছিল।
এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে পোল্যান্ডের সীমানা থেকে... পীত সাগর পর্যন্ত মঙ্গোল সাম্রাজ্যের দখলে ছিল। এ বিশাল সাম্রাজ্য যেটি ছিঙ্গিস জয় করেছিল .. বেশ কয়েকটি মহান রাজতন্ত্রে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছিল... এবং বিশাল আকারে যুদ্ধ ইতিমধ্যেই শুরু হবার সময় হয়েছিল।

"ছিঙ্গিস" হল চেঙ্গিজ খান এর একটি বিকল্প বানান। তার বংশধররা বিশাল আকারে যুদ্ধ করে মঙ্গোল সাম্রাজ্য বিভক্ত করতে লিপ্ত ছিল; এছিল মঙ্গোল বংশধরদের মধ্যে ক্ষমতার জন্য এক প্রতিদ্বন্দ্বিতার চক্র।

পশ্চিমে যাত্রা

সম্পাদনা

পোলো নিজে জাপান সফর করেননি তবে তিনি "চিপাঙ্গু" এবং কুবলাই খানের আক্রমণের ব্যর্থ প্রচেষ্টার মোটামুটি বিশদ বিবরণ দিতে বিমুখ ছিলেন।

তারা খানকে শ্রদ্ধা জানাতে ইন্দোচীন রাজ্যের চম্পায় থামে। এটি কোথায় ছিল তা পুরোপুরি পরিষ্কার করে উল্লেখ নেই, সম্ভবত আধুনিক ভিয়েতনামের কোথাও হতে পারে। পোলো বর্ণনা করেছেন জাভা, তবে তিনি আসলে এটি পরিদর্শন করেছেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। পোলো মালাইউর নামে একটি শহরে তারা থামল। এটি আধুনিক সিঙ্গাপুর এবং মালাক্কা অঞ্চলে ছিল, কিন্তু মনে হয় না যে এটি উভয়ের একটি ছিল।

তারপরে, তারা সুমাত্রা-এ বেশ কয়েক মাস কাটিয়েছেন, সম্ভবত বর্ষা মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করছেন। পোলো এটিকে "লেসার জাভা" বলে উল্লেখ করেছিলেন এবং বিভিন্ন রাজ্য, বাণিজ্য, ধর্ম এবং সংস্কৃতির অনেক বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। তারা ভারতে যাওয়ার পথে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কাও পরিদর্শন করেন।

ভারত ভ্রমণের সময় তিনি মাদ্রাজ এর কাছে সেন্ট থমাসের সমাধি সহ পূর্ব উপকূলের বেশ কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করেন। পশ্চিম উপকূলে, প্রথম বিরতি স্বাভাবিকভাবেই ছিল মালাবার উপকূলের কালিকট, যা এখন কেরালা, তারপর তারা উপকূল বরাবর এগিয়ে বোম্বে এর কাছের থানে এবং গুজরাতে এর কাছে খম্ভাত যান। তিনি সিন্ধু সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন কিন্তু সেখানে থেমেছিলেন বলে মনে হয় না। এছাড়াও তিনি দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ প্রদেশের বর্ণনা দিয়েছেন।

তিনি ভারত মহাসাগরের সোকোট্রা দ্বীপকে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন, তারপর মাদাগাস্কার এবং জাঞ্জিবার সম্পর্কে লিখেছেন যা বেশ ভুল তথ্যপূর্ণ । সম্ভবত তিনি এ ব্যপারে অন্য ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে গল্প শুনে তার পুনরাবৃত্তি করছিলেন। তিনি আবিসিনিয়া, যা বর্তমানে সোমালিয়া এবং ইরিত্রিয়া বর্ণনা করেছেন, তবে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। তিনি ইয়েমেন এর একটি শহর এডেন নিয়েও আলোচনা করেছেন, যা তখন একটি সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল যার মধ্যে সোমালিয়া এবং ইরিত্রিয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু তিনি সেখানে গিয়েছিলেন কিনা তা স্পষ্ট নয়।

এই এডেন হল সেই বন্দর যেখানে ভারতের অনেক জাহাজ তাদের মালামাল নিয়ে আসে; এবং এই আশ্রয়স্থল থেকে বণিকরা সাত দিন দূরত্বে ছোট জাহাজে করে পণ্য বহন করে। এই সাত দিনে তারা মালপত্র নামানো শেষ করে এবং উটের উপর বোঝাই করে, এবং তাই তাদের ৩০ দিনের স্থলযাত্রা হয়। এটি তাদের আলেকজান্দ্রিয়ার নদীতে নিয়ে আসে এবং এর মাধ্যমে তারা পরবর্তী শহরে চলে যেতে পারে। এডেনের মধ্য দিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার সারাসেনরা তাদের মরিচ এবং অন্যান্য মশলাদার সব ভাণ্ডার পায়; এবং সমান ভাল এবং সুবিধাজনক অন্য কোন পথ নেই যার দ্বারা এই পণ্যগুলো সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারে।

অবশেষে তারা হরমুজ পৌঁছে এবং এখান থেকে কনেকে পৌঁছে দেবার জন্য তাবরিজ পর্যন্ত যায়। এরই মধ্যে পূর্বপরিকল্পিত বর মারা যাওয়ার পর সে তার ছেলেকে বিয়ে করে।

এরপর পোলোরা বাড়ি ফিরে আসে, কৃষ্ণ সাগরের ট্রেবিজন্ড (ট্রাবজন) থেকে কনস্টান্টিনোপল (ইস্তানবুল) হয়ে তারা ১২৯৫ সালে ভেনিস পৌঁছেছিল।

আরও দেখুন

সম্পাদনা
এই ভ্রমণপথ to মার্কো পোলোর ট্রেইল পথপ্রদর্শক অবস্থা তালিকাভুক্ত লেখা১ লেখা২

{{#assessment:ভ্রমণপথ|পথপ্রদর্শক}}