ভারতের মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গ

পশ্চিমবঙ্গ হল ভারতের একটি রাজ্য। এই রাজ্যটি পূর্ব ভারতে বঙ্গোপসাগরের উত্তর দিকে অবস্থিত। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, এই রাজ্যের জনসংখ্যা ৯ কোটি ১৩ লক্ষেরও বেশি। জনসংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের চতুর্থ সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য। এই রাজ্যের আয়তন ৮৮,৭৫২ কিমি। ভৌগোলিক দিক থেকে দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল, গাঙ্গেয় বদ্বীপ, রাঢ় অঞ্চল ও উপকূলীয় সুন্দরবনের অংশবিশেষ এই রাজ্যের অন্তর্গত। বাঙালি এই রাজ্যের প্রধান জাতিগোষ্ঠী এবং রাজ্যের জনসংখ্যার প্রধান ধর্ম হিন্দুধর্ম

প্রাচীন বাংলা ছিল একাধিক প্রধান জনপদের কেন্দ্রস্থল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সম্রাট অশোক এই অঞ্চলটি জয় করেন। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে এই অঞ্চল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। দশম শতাব্দীর পর থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্ন পর্যন্ত একাধিক সুলতান, শক্তিশালী হিন্দু রাজন্যবর্গ ও বারো ভুঁইয়া নামধারী জমিদারেরা এই অঞ্চল শাসন করেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। এরপর দীর্ঘকাল কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। দীর্ঘকাল ব্রিটিশ প্রশাসনের কেন্দ্রস্থলে থাকার সুবাদে বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক পাশ্চাত্য শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের সূচনা ঘটে। এই ঘটনা পরবর্তীকালে বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাংলা ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময় ধর্মের ভিত্তিতে এই অঞ্চল দ্বিখণ্ডিত হয়। বাংলার পূর্ব ভূখণ্ড নিয়ে নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব বাংলা (পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ এবং অধুনা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র) গঠিত হয়। অন্যদিকে পশ্চিম ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাম সরকার পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছিল। বিশ্বের ইতিহাসে এই বাম সরকারই ছিল সর্বাপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী নির্বাচিত সাম্যবাদী সরকার।

মানচিত্র
পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র
পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র

পশ্চিমবঙ্গে ৫টি বিভাগ ২৩টি জেলা রয়েছে এবং ঐতিহাসিক কারণে পশ্চিমবঙ্গকে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গে ভাগ করা হয়। তবে এই নিবন্ধের উদ্দেশ্যে একে ৯টি ভ্রমণ অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে।

উত্তরবঙ্গ

সম্পাদনা

 দার্জিলিং পাহাড় (উত্তর দার্জিলিং, কালিম্পং)
পশ্চিমবঙ্গের হিমালয় অংশ। ঐতিহ্যবাহী টয় ট্রেন ও চিত্তাকর্ষক পর্বতমালা এর প্রধান আকর্ষণ।
 উত্তরের সমভূমি (আলিপুরদুয়ার, উত্তর দিনাজপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দক্ষিণ দার্জিলিং, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ)
পাহাড়ের পাদদেশের সতেজ সবুজ অঞ্চল। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী, অরণ্য ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য এর প্রধান আকর্ষণ।

দক্ষিণবঙ্গ

সম্পাদনা

 বীরভূম
রাঙা মাটির দেশ, স্থানীয় সংস্কৃতি, ধর্মস্থান ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্য পরিচিত।
 হাওড়া ও হুগলি
হাওড়া কলকাতার যমজ শহর এবং পশ্চিমবঙ্গের এক প্রধান পরিবহন কেন্দ্র। হুগলি এক বিশাল শিল্পাঞ্চল যেখানে রংবেরঙের সংস্কৃতি লক্ষ করা যায়।
 কলকাতা
আনন্দনগরী ও প্রাসাদনগরী, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী ও সবচেয়ে জনবহুল শহর, ব্রিটিশ ভারতের প্রাক্তন রাজধানী।
 নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ
নদিয়া পশ্চিমবঙ্গের বৈষ্ণব ধর্মের কেন্দ্র। মুর্শিদাবাদ নবাব আমলে বাংলার রাজধানী।
 চব্বিশ পরগনা (উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা)
কলকাতা শহরের ঘিঞ্জি পরিবেশের উপকণ্ঠে সুন্দরবন সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পাওয়া যায়।
 রাঢ় (পশ্চিম বর্ধমান, পুরুলিয়া, পূর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া)
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলে এক বিশাল ঐতিহাসিক এলাকা।
 মেদিনীপুর (ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর)
পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন ও আধুনিক বন্দর, চিত্তাকর্ষক সৈকত ও বন্ধুর ভূমিরূপের জন্য পরিচিত।
দার্জিলিঙের চা বাগান।
  • 1 কলকাতা আনন্দনগরী ও প্রাসাদনগরী, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী ও সবচেয়ে জনবহুল শহর, ব্রিটিশ ভারতের প্রাক্তন রাজধানী।
  • 2 চন্দননগর প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশ। জগদ্ধাত্রী পূজার জন্য বিখ্যাত।
  • 3 দার্জিলিং মনোরম পাহাড়ি শহর এবং অন্যতম প্রধান চা উৎপাদন কেন্দ্র।
  • 4 দুর্গাপুর এক শিল্পকেন্দ্রিক নগর।
  • 5 বর্ধমান প্রধান কৃষিভিত্তিক শহর।
  • 6 মুর্শিদাবাদ নবাব আমলে বাংলার রাজধানী।
  • 7 শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর, বিভিন্ন হস্তশিল্পের সামগ্রীর জন্য পরিচিত, ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত।
  • 8 শিলিগুড়ি উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র ও কেনাকাটার জায়গা। সিকিম এবং উত্তর পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার।
  • 9 হাওড়া কলকাতার যমজ শহর, রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ভারতের বৃহত্তম রেলওয়ে স্টেশনের জন্য পরিচিত।

অন্যান্য গন্তব্য

সম্পাদনা
সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান

অনুধাবন

সম্পাদনা

নামকরণ

সম্পাদনা

"পশ্চিমবঙ্গ" নামটি ১৯৪৭-এর ভারত বিভাজনের সময় প্রাক্তন বঙ্গ প্রদেশের পশ্চিমাংশ থেকে উদ্ভূত রাজ্যের নাম হিসেবে উদ্ভূত। বাকি পূর্বাংশ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের অংশ ছিল, পরে এটি স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়েছিল। তবে "বঙ্গ" নামের সঠিক উৎস নিশ্চিত নয় (দেখুন বঙ্গ#নাম)।

ইতিহাস

সম্পাদনা
লুকোচুরি দরওয়াজা, গৌড়
হাজারদুয়ারী রাজপ্রাসাদ, মুর্শিদাবাদ

বৃহত্তর বঙ্গদেশে সভ্যতার সূচনা ঘটে আজ থেকে ৪,০০০ বছর আগে। এই সময় দ্রাবিড়, তিব্বতি-বর্মি ও অস্ত্রো-এশীয় জাতিগোষ্ঠী এই অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। বঙ্গ বা বাংলা শব্দের প্রকৃত উৎস অজ্ঞাত। তবে মনে করা হয়, ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ যে দ্রাবিড়-ভাষী বং জাতিগোষ্ঠী এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল, তারই নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ হয় বঙ্গ। গ্রিক সূত্র থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১০০ অব্দ নাগাদ গঙ্গারিডাই নামক একটি অঞ্চলের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সম্ভবত এটি বৈদেশিক সাহিত্যে বাংলার প্রাচীনতম উল্লেখগুলির অন্যতম। মনে করা হয়, এই গঙ্গারিডাই শব্দটি গঙ্গাহৃদ (অর্থাৎ, গঙ্গা যে অঞ্চলের হৃদয়ে প্রবাহিত) শব্দের অপভ্রংশ। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে বাংলা ও বিহার অঞ্চল নিয়ে গড়ে ওঠে মগধ রাজ্য। একাধিক মহাজনপদের সমষ্টি এই মগধ রাজ্য ছিল মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক ভারতের চারটি প্রধান রাজ্যের অন্যতম। মৌর্য রাজবংশের রাজত্বকালে প্রায় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে এই সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি মহামতি অশোকের রাজত্বকালে আফগানিস্তান ও পারস্যের কিছু অংশও এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

প্রাচীনকালে জাভা, সুমাত্রা ও শ্যামদেশের (অধুনা থাইল্যান্ড) সঙ্গে বাংলার বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ মহাবংশ অনুসারে, বিজয় সিংহ নামে বঙ্গ রাজ্যের এক রাজপুত্র লঙ্কা (অধুনা শ্রীলঙ্কা) জয় করেন এবং সেই দেশের নতুন নাম রাখেন সিংহল। প্রাচীন বাংলার অধিবাসীরা মালয় দ্বীপপুঞ্জ ও শ্যামদেশে গিয়ে সেখানে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন।

খ্রিষ্টীয় তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে মগধ রাজ্য ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র। বঙ্গের প্রথম সার্বভৌম রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগে তিনি একাধিক ছোটো ছোটো রাজ্যে বিভক্ত সমগ্র বঙ্গ অঞ্চলটিকে একত্রিত করে একটি সুসংহত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। শশাঙ্কের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ (অধুনা মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙামাটি অঞ্চল)। তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে বঙ্গের ইতিহাসে এক নৈরাজ্যের অবস্থা সৃষ্টি। ইতিহাসে এই সময়টি "মাৎস্যন্যায়" নামে পরিচিত। এরপর চারশো বছর বৌদ্ধ পাল রাজবংশ এবং তারপর কিছুকাল হিন্দু সেন রাজবংশ এই অঞ্চল শাসন করেন। পাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র (অধুনা পাটনা, বিহার) এবং পরে গৌড় (মালদহ জেলা)। সেন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল নবদ্বীপ (নদিয়া জেলা)। এরপর ভারতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটলে বঙ্গ অঞ্চলেও ইসলাম ধর্মে প্রসার ঘটে। বকতিয়ার খলজি নামে দিল্লি সুলতানির দাস রাজবংশের এক তুর্কি সেনানায়ক সর্বশেষ সেন রাজা লক্ষ্মণসেনকে পরাস্ত করে বঙ্গের একটি বিরাট অঞ্চল অধিকার করে নেন। এরপর কয়েক শতাব্দী এই অঞ্চল দিল্লি সুলতানির অধীনস্থ সুলতান রাজবংশ অথবা সামন্ত প্রভুদের দ্বারা শাসিত হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সেনানায়ক ইসলাম খাঁ বঙ্গ অধিকার করেন। যদিও মুঘল সাম্রাজ্যের রাজদরবার সুবা বাংলার শাসকদের শাসনকার্যের ব্যাপারে আধা-স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন। এই অঞ্চলের শাসনভার ন্যস্ত হয়েছিল মুর্শিদাবাদের নবাবদের হাতে। নবাবেরাও দিল্লির মুঘল সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

মন্দারমণি সমুদ্র সৈকতে দৃশ্যমান একটি নৌকা।

পূর্ব ভারতে হিমালয়ের দক্ষিণে ও বঙ্গোপসাগরের উত্তরে এক সংকীর্ণ অংশে পশ্চিমবঙ্গ অবস্থিত। রাজ্যের মোট আয়তন ৮৮,৭৫২ বর্গকিলোমিটার (৩৪,২৬৭ বর্গমাইল)। রাজ্যের সর্বোত্তরে অবস্থিত দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল পূর্ব হিমালয়ের একটি অংশ। পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সান্দাকফু (৩,৬৩৬ মিটার বা ১১,৯২৯ ফুট) এই অঞ্চলে অবস্থিত। এই পার্বত্য অঞ্চলকে দক্ষিণে গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে সংকীর্ণ তরাই অঞ্চল। অন্যদিকে রাঢ় অঞ্চল গাঙ্গেয় বদ্বীপকে বিচ্ছিন্ন করেছে পশ্চিমের মালভূমি ও উচ্চভূমি অঞ্চলের থেকে। রাজ্যের সর্বদক্ষিণে একটি নাতিদীর্ঘ উপকূলীয় সমভূমিও বিদ্যমান। অন্যদিকে সুন্দরবন অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ অরণ্য গাঙ্গেয় বদ্বীপের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য।

জলবায়ু

সম্পাদনা

পশ্চিমবঙ্গ পাঁচটি ঋতু বর্তমান: বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত।

বসন্তকাল ছোট এবং উত্তরে এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গ্রীষ্মকাল মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয় এবং জুন পর্যন্ত চলে। দিনের বেলায় আবহাওয়া গরম ও আর্দ্র থাকে এবং রাতে ঠান্ডা বাতাস থেকে। পশ্চিমের উচ্চভূমির আবহাওয়া গরম ও শুষ্ক হয়। গ্রীষ্মের শেষে কালবৈশাখী ঝড় হয়। জুলাই মাসে বর্ষাকাল শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বরের শেষে এটি শেষ হয় যখন মুষলধারে বৃষ্টির ফলে দক্ষিণে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়। শরৎকাল ক্ষণস্থায়ী, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের মধ্যে। সেই সময় ক্ষয়িষ্ণু মৌসুমী বায়ুর ফলে ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। নভেম্বর মাসের শেষে শীতকাল শুরু হয় এবং ফেব্রুয়ারি মাসে বসন্তকাল আসা পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। জানুয়ারি মাস শীতলতম। উত্তরের হিমালয় অঞ্চলে শীতকালে তুষারপাত হয়, বিশেষ করে ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি।

সমভূমিতে গ্রীষ্মকালের সময় তাপমাত্রা ২৬ °সে থেকে ৪০ °সে পর্যন্ত বিস্তৃত। শীতকালের সময় তাপমাত্রা ১৩ °সে থেকে ১৯ °সে পর্যন্ত বিস্তৃত। দার্জিলিং পাহাড়ের গড় তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে প্রায় ১৫ °সে ও শীতকালে প্রায় ২ °সে হয়।

উত্তরবঙ্গে বৃষ্টিপাত সর্বোচ্চ হয়, কিন্তু রাঢ় অঞ্চলে বৃষ্টিপাত সবচেয়ে কম হয়। উপকূলবর্তী অঞ্চলে মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়। পুরুলিয়ায় খরার মতো অবস্থা লক্ষ করা যায়।

পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ও প্রধান ভাষা বাংলা। তবে এই অঞ্চলের বাংলা বাংলাদেশে প্রচলিত বাংলার থেকে সামান্য আলাদা। এখনকার লোকেরা "পানি" না বলে "জল" বলেন, এবং কিছু শব্দে "উ"-এর জায়গায় "ও" উচ্চারণ করার প্রবণতা আছে, যেমন: "বুঝায়"-কে "বোঝায়" উচ্চারণ করা হয়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ পাওয়া যায়, যা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে আলোচিত। শহরাঞ্চলে বাংলার সঙ্গে বহু ইংরেজি শব্দ ব্যবহৃত হয়, তাই এই নিবন্ধে অনেকসময় সাধারণ বাংলা শব্দের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে সুপরিচিত ইংরেজি শব্দ যোগ করা হয়েছে।

দার্জিলিং পাহাড়ে নেপালি ভাষা প্রচলিত, তবে সেখানকার স্থানীয়রা বাংলা বুঝতে পারেন।

প্রবেশ

সম্পাদনা

আকাশপথে

সম্পাদনা

কলকাতায় অবস্থিত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (CCU আইএটিএ) পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিমানবন্দর। এছাড়া শিলিগুড়ি, দুর্গাপুরকোচবিহার বিমানবন্দরে যাত্রী পরিষেবা বর্তমান।

রেলপথে

সম্পাদনা
হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন

রেলপথ পশ্চিমবঙ্গকে সবদিক থেকে অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। কিছু প্রধান রেলওয়ে স্টেশন হলো হাওড়া, কলকাতা (শিয়ালদহ), শিলিগুড়ি (নিউ জলপাইগুড়ি), আসানসোল ইত্যাদি।

সড়কপথে

সম্পাদনা

কলকাতা ভারতের স্বর্ণ চতুর্ভুজ সড়কের একটি শীর্ষ এবং এই সড়কটি ভারতের অন্যান্য প্রধান শহরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় ও রাজ্য সড়ক পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।

কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের প্রধান যাত্রীবাহী বন্দর।

ঘুরে দেখুন

সম্পাদনা

রেলপথে

সম্পাদনা
পাঁশকুড়ার চিত্তাকর্ষক ফুলের বাগান থেকে একটি লোকাল ট্রেনের দৃশ্য।
আরও দেখুন: ভারতে রেল ভ্রমণ

পশ্চিমবঙ্গের রেল নেটওয়ার্ক অত্যন্ত বিস্তৃত এবং এটি পূর্ব রেল (ER), দক্ষিণ পূর্ব রেল (SER) ও উত্তরপূর্ব সীমান্ত রেল (NFR) অঞ্চলের অন্তর্গত। রাজ্যের বাইরে থেকে বিভিন্ন মেল ও এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়াও রাজ্যের মধ্যে কিছু দ্রুত ট্রেন এবং একাধিক প্যাসেঞ্জার ও লোকাল ট্রেন আছে।

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশে কলকাতা শহরতলি রেল পরিচালিত হয়, যা অনেকসময় "লোকাল ট্রেন" নামে পরিচিত। রুট অনুযায়ী লোকাল ট্রেনে অনেক ভিড় হয়। বেসরকারি গাড়ি বা ট্যাক্সির তুলনায় ট্রেনে যাতায়াত করলে খরচ তুলনায় কম হয়।

বাসে করে

সম্পাদনা

উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা (এনবিএসটিসি), দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা (এসবিএসটিসি) ও পশ্চিমবঙ্গ পরিবহন নিগমের (ডব্লুবিটিসি) মতো সরকারি পরিবহন সংস্থা রাজ্যের সমস্ত প্রান্ত ও পূর্ব ভারতে বাস পরিষেবা প্রদান করে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যের মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস পরিষেবা প্রদান করে।

রিকশা করে

সম্পাদনা

রিকশা পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিবহন মাধ্যম, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি দূরত্বের জন্য। রাজ্য জুড়ে তিন ধরনের রিকশা প্রচলিত: সাইকেল রিকশা, অটোরিকশা ("অটো" নামে পরিচিত) ও বৈদ্যুতিক রিকশা ("টোটো" নামে পরিচিত)। কোনো পর্যটক দেখলেই টোটোচালক বেশি খরচ হাঁকতে পারে। সাধারণত টোটোর যাত্রা স্বল্প দূরত্বের হয় এবং এর ২০২২-এর হিসেব অনুযায়ী এর খরচ মাথাপিছু ₹১০–১৫।

গাড়িতে

সম্পাদনা

বিভিন্ন মহাসড়ক ও এক্সপ্রেসওয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন শহর ও প্রতিবেশী রাজ্যের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। উৎসবের মরসুম ছাড়া শহরাঞ্চলের বাইরে তেমন ট্র্যাফিক থাকে না। বেশিরভাগ গ্রাম পাকা রাস্তার মাধ্যমে সংযুক্ত। ভারতের অন্যপ্রান্তের মতো পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জাতীয় সড়ক ও এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন টোল প্লাজায় ফাস্ট্যাগের মাধ্যমে আপনাকে টোল কর দিতে হবে। গাড়ির ধরন অনুযায়ী টোল করের মান ভিন্ন।

যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ একটি নদীমাতৃক রাজ্য, সেহেতু এর বিভিন্ন নদী বরাবর বিভিন্ন ফেরি পরিষেবা পাওয়া যায়, যা এই রাজ্যের বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক জায়গায় নিয়ে যায়। বিশেষত ভাগীরথী হুগলি নদী বরাবর একাধিক ফেরি পরিষেবা পাওয়া যায়।

দেখুন ও করুন

সম্পাদনা
হাওড়া সেতু, কলকাতা
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বিশাল প্রাকৃতিক ও স্থাপত্য ঐতিহ্য বর্তমান। হাওড়া সেতু, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালবিদ্যাসাগর সেতু কেবল কলকাতার প্রতীক নয়, সমগ্র রাজ্যের প্রতীক। রাজ্যের জাদুঘর ও স্থাপত্যের এক বড় অংশ কলকাতায় থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের বাকি অংশকে ভুললে চলবে না। রাজ্য জুড়ে একাধিক শহর, গ্রাম ও জাতীয় উদ্যান আছে, যার মধ্যে তিনটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত।

ঐতিহাসিক আকর্ষণ

সম্পাদনা

ব্রিটিশ আমলে পশ্চিমবঙ্গ, তথা সমগ্র বঙ্গ, ভারতের সংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। রাজ্যের বিভিন্ন স্থাপত্য ও ধর্মস্থান বিভিন্ন সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত এবং এদের পৃথক স্থাপত্যশৈলী যেন সেই নির্মাণের সময়কার কথা বলে। ব্রিটিশ প্রভাবের ফলে ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে একাধিক ভবন নির্মিত হয়েছে।

প্রাকৃতিক আকর্ষণ

সম্পাদনা

পশ্চিমবঙ্গের প্রাকৃতিক আকর্ষণ বৈচিত্র্যপূর্ণ, উত্তরের বরফাবৃত দার্জিলিং পাহাড় থেকে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবন পর্যন্ত। সুন্দরবন থেকে ওড়িশা সীমান্ত পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চলে বেশ কিছু সুন্দর সৈকতনগরী আছে, যার মধ্যে দীঘা, শংকরপুর, মন্দারমণি, বকখালিসাগর দ্বীপ উল্লেখযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম ভাগে অবস্থিত ছোটনাগপুর মালভূমিতে নিচু পাহাড় ও অন্যান্য চড়াইভাতি অঞ্চল আছে।

ভ্রমণসূচী

সম্পাদনা
বাতাসিয়া লুপে দার্জিলিং টয় ট্রেন
  • দার্জিলিং হিমালয়ান রেল (টয় ট্রেন) — ভারতীয় রেল দ্বারা পরিচালিত শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত বিস্তৃত এক ন্যারো-গেজ রেল পরিষেবা। ১৮৭৯ থেকে ১৮৮১ পর্যন্ত পর্যন্ত এটি নির্মিত হয়েছিল এবং এর দৈর্ঘ্য ৮৬ কিমি দীর্ঘ। এটি স্টিম ও ডিজেল ইঞ্জিন দ্বারা চালিত এবং পাহাড়ে চড়ার সময় এটি এলাকার বিস্তৃত দৃশ্য প্রদান করে। এটি এক ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত এবং এই রুটটি পর্যটকদের জন্য খুবই জনপ্রিয় যেহেতু এটি চিত্তাকর্ষক পাহাড়ের দিয়ে যাচ্ছে।
  • গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড — এর প্রধান রুট হাওড়া থেকে শুরু হচ্ছে এবং হুগলি নদী বরাবর দিয়ে গিয়ে এটি উত্তরপশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে রাঢ় অঞ্চলে প্রবেশ করছে।
  • সান্দাকফু–ফালুট ট্রেক — সান্দাকফু (৩,৬৩৬ মি) পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এবং ফালুট (৩,৬০০ মি) পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে উত্তরের বিন্দু। এই ট্রেক এই শৃঙ্গ দুটিকে সম্মিলিত করে এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা ও মাউন্ট এভারেস্ট সহ বিভিন্ন বরফাবৃত পর্বতশৃঙ্গের দৃশ্য প্রদান করে।

আহার ও পানীয়

সম্পাদনা
সাধারণ বাঙালি প্রাতরাশ, যা লুচি সহ আলুর দম, ডাল ও সন্দেশ নিয়ে গঠিত।

পশ্চিমবঙ্গ মাছ প্রস্তুতি ও মিষ্টান্নের জন্য পরিচিত, কিন্তু বেশ কিছু নিরামিষ আহারও এর বৈশিষ্ট্য। বিগত শতাব্দীতে বিধবাদের নিরামিষ ছাড়া অন্য কিছু খাওয়া নিষেধ ছিল (বর্তমানে এই নিয়ম আর তেমন মানা হয় না), এবং এঁরা বড় বাড়িতে প্রধান রাঁধুনির কাজ করতেন। এই বিধবাগণ নিরামিষ আহার প্রস্তুত করতেন।

পশ্চিমবঙ্গ দুগ্ধজাত পণ্য থেকে বিভিন্নরকম মিষ্টান্ন প্রস্তুতির জন্য পরিচিত, যেমন: রসগোল্লা, পান্তুয়া, রসমালাই, চমচম, কালোজাম, মিষ্টি দই ও বিভিন্নরকম সন্দেশ। এগুলি সমগ্র ভারতে বিখ্যাত। লক্ষ্মীপূজার সময় নারকেল-নাড়ু, তিল-নাড়ু, মোয়া ও পায়েস তৈরি করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত রাস্তার খাবার হলো আলুর চপ, বেগনি, ঝালমুড়ি ও ফুচকা।

কলকাতার মতো শহরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সবরকমের খাবার পাওয়া যায়, এমনকি চীনা ("চাইনিজ") ও থাই খাবারও পাওয়া যায়। অন্যান্য শহরে সাধারণত বাঙালি রেস্তোরাঁ থাকলেও সেখানে পাঞ্জাবি, উত্তর ভারতীয় ("নর্থ ইন্ডিয়ান") ও দক্ষিণ ভারতীয় ("সাউথ ইন্ডিয়ান") খাবার পাওয়া যেতে পারে। মোগলাই খাবার ও বিরিয়ানি অত্যন্ত জনপ্রিয়।

রাত্রিযাপন

সম্পাদনা

ভারতের অন্যান্য প্রান্তের মতো পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি–দুই রকমের হোটেল পাওয়া যায়। বেশিরভাগ সরকারি লজ পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগম দ্বারা পরিচালিত, এবং কলকাতাশিলিগুড়ির পর্যটন কেন্দ্র থেকে এই লজগুলি ভাড়া করা যায়।

নিরাপদে থাকুন

সম্পাদনা

পশ্চিমবঙ্গ বিদেশিদের কাছে অত্যন্ত নিরাপদ। এখনকার লোকেরা বন্ধুত্বপূর্ণ এবং বিভিন্ন সংস্কৃতিকে সাদরে গ্রহণ করেন। তবে লোকেরা আপনার সঙ্গে আপত্তিকর আচরণ করলে আপনি সাহসের সঙ্গে এর মোকাবিলা করবেন এবং সাহায্য চাইবেন।

পশ্চিমবঙ্গ রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয়। আপনি সেখানে সংঘর্ষ লক্ষ করবেন, যা সাধারণত শাসক ও বিরোধী দলের মদতপুষ্ট ছাত্রদের মধ্যে হয়। সবচেয়ে ভাল হয় যদি আপনি এই ব্যাপার থেকে দূরে থেকে সেই এলাকা ত্যাগ করুন, যেহেতু সেখানে অনেকসময় এমনকি পুলিশও শামিল থাকতে পারেন।

বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তের কাছে যাওয়ার সময় আপনাকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে লোকেদের বেআইনি অনুপ্রবেশের ঘটনা পাওয়া যায় এবং সীমান্ত বরাবর মাদক পাচার যথেষ্ট হয়। দরকার হলে আপনি বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) সাহায্য নিতে পারেন।

প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা

সম্পাদনা

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ভাগে বন্যার সম্ভাবনা যথেষ্ট বেশি, যেহেতু এই এলাকাটি মূলত পলি দ্বারা গঠিত। মুষলধারে বৃষ্টির সময় নদীনালা উপচে পড়ে যায়। এছাড়া রাজ্যের উপকূলে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় থেকে সাবধান থাকবেন।

দার্জিলিং পাহাড়েও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং শীতকালে যথেষ্ট তুষারপাত হয়। উচ্চতাজনিত রোগ এই অঞ্চলের অন্যতম সমস্যা।