যুক্তরাজ্যের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর লন্ডন (ইংরেজি: London) বিভিন্ন মানুষ, সংস্কৃতি ও ধারণার সঙ্গমস্থল। কোলাহলপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর এই শহর টেমস নদীর (River Thames) ধারে অবস্থিত। এখানে ৯০ লক্ষের বেশি মানুষের বাস। অন্যতম "বৈশ্বিক শহর" হিসাবে পরিচিত লন্ডন সংস্কৃতি, সঙ্গীত, শিক্ষা, রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক রাজধানী। এখানে লক্ষাধিক ঐতিহাসিক স্থান, কেনাকাটা, জাদুঘর, খাবারদাবার, চিত্রশালা ও কর্মকাণ্ড রয়েছে।
অঞ্চল
সম্পাদনাআগে "লন্ডন" বলতে কেবল একদা প্রাচীর দ্বারা আবদ্ধ "স্কোয়ার মাইল"-কে (Square Mile) বোঝাত, যা রোমান আমলের ও মধ্যযুগের একটি শহর ছিল; বর্তমানে ঐ অংশটি "সিটি অফ লন্ডন" (City of London) বা সংক্ষেপে "সিটি" (City) নামে পরিচিত। অন্যদিকে, শুধু "লন্ডন" বলতে বর্তমানের বৃহত্তর মহানগরকে বোঝায় এবং বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে লন্ডন আশেপাশের অনেক শহর ও গ্রামসহ বিভিন্ন "হোম কাউন্টি"-র (home county) বড় অংশকে আত্মসাৎ করেছিল, যার মধ্যে মিডলসেক্সের (Middlesex) পুরোটাই লন্ডনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ হলেও লন্ডনে, এমনকি নগরকেন্দ্রে অনেক বিশাল সবুজ উদ্যান ও ময়দান রয়েছে।
মধ্য লন্ডন
সম্পাদনাওয়েস্টমিনস্টার (Westminster) (ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি, ওয়েস্টমিনস্টার ক্যাথিড্রাল, ওয়েস্টমিনস্টার প্রাসাদ, ডাউনিং স্ট্রিট, বাকিংহাম প্রাসাদ, হর্স গার্ডস) যুক্তরাজ্য সরকারের এলাকা, যা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক আকর্ষণে পরিপূর্ণ। এছাড়া আরাম উপভোগ করার জন্য গ্রিন পার্ক ও সেন্ট জেমস পার্ক রয়েছে। |
কোভেন্ট গার্ডেন (Covent Garden) (কোভেন্ট গার্ডেন পিয়াৎসা, রয়েল অপেরা হাউস, লন্ডন ট্রান্সপোর্ট মিউজিয়াম) অন্যতম কেনাকাটা ও বিনোদন এলাকা এবং এটি লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ড থিয়েটারল্যান্ডের (West End Theatreland) অংশ। |
দক্ষিণ কেনসিংটন-চেলসি (South Kensington-Chelsea) (কেনসিংটন গার্ডেনস, কেনসিংটন প্রাসাদ, ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম, রয়েল অ্যালবার্ট হল, সায়েন্স মিউজিয়াম) মধ্য লন্ডনের অত্যন্ত অভিজাত এলাকা। এখানে বিখ্যাত ডিপার্টমেন্টাল দোকান, হাইড পার্ক, জাদুঘর ও কিংস রোড রয়েছে। |
নটিং হিল-উত্তর কেনসিংটন (Notting Hill-North Kensington) (ডিজাইন মিউজিয়াম, পোর্টোবেলো রোড মার্কেট, মিউজিয়াম অফ ব্র্যান্ডস, হল্যান্ড পার্ক) ফল ও অ্যান্টিকের দোকান, আকর্ষণীয় ইতিহাস, বিশ্ববিখ্যাত কার্নিভাল এবং অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগণ। |
প্যাডিংটন-মেইডা ভেল (Paddington-Maida Vale) (অ্যাবি রোড, লর্ডস ক্রিকেট মাঠ, লিটল ভেনিস) উত্তরপশ্চিম-মধ্য লন্ডনের মূলত আবাসিক এলাকা। এখানে প্রচুর মধ্যম-মানের বাসস্থানসহ খাল ও হাউজবোট রয়েছে। |
ব্লুমসবরি (Bloomsbury) (ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন, ওয়েলকাম কালেকশন, কার্টুন মিউজিয়াম, ফাউন্ডলিং মিউজিয়াম, ব্রিটিশ জাদুঘর) রোমাঞ্চকর ঐতিহাসিক এলাকা, যা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের একদল লেখকদের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। এটি বিভিন্ন ঐতিহাসিক বাড়ির ঠিকানা। |
মেফেয়ার-মার্লিবন (Mayfair-Marylebone) (ওয়ালেস কালেকশন, ম্যাডাম টুসডজ, রয়েল অ্যাকাডেমি অফ আর্টস, রিজেন্ট পার্ক, লন্ডন চিড়িয়াখানা) পশ্চিম-মধ্য লন্ডনের অন্যতম অভিজাত এলাকা। এখানে লন্ডনের প্রধান কেনাকাটার রাস্তা রয়েছে, যেমন অক্সফোর্ড স্ট্রিট, বন্ড স্ট্রিট, রিজেন্ট স্ট্রিট ও স্যাভিল রো। |
লেস্টার স্কোয়ার (Leicester Square) (ট্রাফালগার স্কোয়ার, ন্যাশনাল গ্যালারি, ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারি, পিকাডিলি সার্কাস) লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ড থিয়েটারল্যান্ডের (West End Theatreland) কেন্দ্র। এখানে যুক্তরাজ্য ও বিশ্বের চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার প্রদর্শনী ও লন্ডনের চায়নাটাউন রয়েছে। |
সাউথ ব্যাংক (South Bank) (টেট মডার্ন, দ্য শার্ড, ন্যাশনাল থিয়েটার, বরো মার্কেট, ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট, লন্ডন আই, শেক্সপিয়ার্স গ্লোব থিয়েটার) মধ্য লন্ডনের একটি বিনোদন ও বাণিজ্যিক এলাকা। |
সিটি অফ লন্ডন (City of London) (টাওয়ার অফ লন্ডন, টাওয়ার ব্রিজ, ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড, মিউজিয়াম অফ লন্ডন, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল) বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র, যেখানে আধুনিক গগনচুম্বী অট্টালিকা মধ্যযুগীয় গির্জার পাশে এবং রোমান যুগের রাস্তার ধারে গড়ে উঠেছে। |
সোহো (Soho) (কার্নাবি স্ট্রিট, সোহো স্কোয়ার) অত্যন্ত কেতাদুরস্ত রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, ক্লাব, জ্যাজ বার ও সমকামী পল্লিতে পরিপূর্ণ। |
হলবর্ন-ক্লার্কেনওয়েল (Holborn-Clerkenwell) (ইনস অফ কোর্ট, রয়েল কোর্টস অফ জাস্টিস, সমারসেট হাউস, স্যাডলারস ওয়েলস, হ্যাটন গার্ডেন) সিটি অফ লন্ডন ও ওয়েস্ট এন্ডের মধ্যবর্তী এলাকা, ইংরেজ অলিখিত আইনের আঁতুড়ঘর। |
অভ্যন্তরীণ লন্ডন
সম্পাদনাআইলিংটন (Islington) (আর্সেনাল এফসি) ক্লার্কেনওয়েলের উত্তরে অবস্থিত এলাকা, যা ১৯৯০ সাল থেকে আধুনিকীকৃত হয়ে আসছে। |
ইস্ট এন্ড (East End) (ইয়ং ভিঅ্যান্ডএ, কলম্বিয়া রোড ফ্লাওয়ার মার্কেট, ডকল্যান্ডস, পেটিকোট লেন মার্কেট, ব্রিক লেন) নগরকেন্দ্রের পূর্বদিকে অবস্থিত শ্রমজীবীদের এলাকা, এবং অগণিত চলচ্চিত্রের জন্য এটি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। এখানে হিপস্টার-ধর্মী বার, উদ্যান, চিত্রশালা, বাংলাটাউন ও অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ রয়েছে। |
ওয়ান্ডসওয়ার্থ (Wandsworth) (ক্ল্যাপহাম কমন, ব্যাটারসি পাওয়ার স্টেশন, ব্যাটারসি পার্ক, লন্ডন ওয়েটল্যান্ড সেন্টার) টেমস নদীর তীরবর্তী এলাকা, উত্তরের উন্মুক্ত সবুজ প্রান্ত এবং দক্ষিণে ঘনবসতি। |
ক্যামডেন (Camden) (ক্যামডেন টাউন মার্কেটস, কিংস ক্রস ও সেন্ট প্যানক্রাস ইন্টারন্যাশনাল স্টেশন, জিউইশ মিউজিয়াম, ব্রিটিশ লাইব্রেরি) উত্তর লন্ডনের একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা। এটি বিকল্প ফ্যাশন ও যুবকেন্দ্রিক বাজারের কেন্দ্র। |
গ্রিনিচ (Greenwich) (ও২ এরিনা, মূল মধ্যরেখা, মেরিটাইম গ্রিনিচ, রয়েল অবজারভেটরি) টেমস নদীর দক্ষিণ তীরের এই এলাকাটি ব্রিটেনের সিফেয়ারিং ঐতিহ্য ও ক্যানারি হোয়ার্ফের চিত্তাকর্ষক দৃশ্যের জন্য পরিচিত। |
ল্যামবেথ (Lambeth) (ইম্পেরিয়াল ওয়ার মিউজিয়াম, ওভাল ক্রিকেট মাঠ, ওল্ড ভিক, ল্যামবেথ প্রাসাদ) টেমস নদীর দক্ষিণে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা। এখানে রয়েছে এলজিবিটি-পন্থী ভক্সহল, মধ্যবিত্ত ক্ল্যাপহাম ও ক্যারিবীয় ব্রিক্সটন। |
সাদার্ক-লুইশাম (Southwark-Lewisham) (ক্রিস্টাল প্যালেস পার্ক, ডালিচ পিকচার গ্যালারি, হর্নিমান মিউজিয়াম) সাধারণত আবাসিক এলাকা এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গমস্থল। এখানে আপনি পৃথিবীর প্রায় যেকোনো জাতির রেস্তোরাঁ পাবেন। |
হ্যাকনি (Hackney) (ভিক্টোরিয়া পার্ক, মিউজিয়াম অফ দ্য হোম, লন্ডন ফিল্ডস, হ্যাকনি এম্পায়ার) |
হ্যামারস্মিথ ও ফুলহাম (Hammersmith and Fulham) (ওয়েস্টফিল্ড হোয়াইট সিটি, চেলসি এফসি, ফুলহাম এফসি, ফুলহাম প্রাসাদ, শেপহার্ডস বুশ এম্পায়ার) পশ্চিম লন্ডনে টেমস নদীর তীরবর্তী অভিজাত এলাকা, যা পেশাদারি ফুটবল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কেনাকাটার লালনভূমি। |
হ্যাম্পস্টেড (Hampstead) (কিটস হাউস, কেনউড হাউস, প্রিমরোজ হিল, ফ্রয়েড মিউজিয়াম, হাইগেট কবরস্থান) |
বহিঃস্থ লন্ডন
সম্পাদনাউইম্বলডন (Wimbledon) (অল ইংল্যান্ড লন টেনিস অ্যান্ড ক্রোকে ক্লাব, উইম্বলডন লন টেনিস মিউজিয়াম, নিউ উইম্বলডন থিয়েটার) বার্ষিক টেনিস প্রতিযোগিতা ও উইম্বলডন কমনের জন্য পরিচিত। |
উত্তর লন্ডন (North London) (আরএএফ মিউজিয়াম, আলেকজান্ড্রা প্রাসাদ, ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম, টটেনহ্যাম হটসপুর এফসি, নিসডেন টেম্পল, হাইগেট উড) মূলত সবুজ মধ্যবিত্ত শহরতলি নিয়ে গঠিত এলাকা, যার বেশিরভাগই আগে মিডলসেক্স, হার্টফোর্ডশায়ার ও বাকিংহামশায়ার কাউন্টির অন্তর্গত ছিল। |
দক্ষিণ লন্ডন (South London) (চিসলহার্স্ট গুহা, চেসিংটন ওয়ার্ল্ড অফ অ্যাডভেঞ্চার্স, ডাউন হাউস) এখানে একাধিক নিত্যযাত্রীদের শহরতলি রয়েছে, যা একদা কেন্ট ও সারে কাউন্টির অন্তর্গত ছিল। এখানকার প্রধান শহরতলির মধ্যে কিংসটন আপন টেমস, ক্রয়ডন, ব্রমলি ও সাটন উল্লেখযোগ্য। |
পশ্চিম লন্ডন (West London) (অস্টারলি পার্ক, চিজিক হাউস, মিউজিকাল মিউজিয়াম, সায়ন পার্ক, হিথরো বিমানবন্দর) এই শহরতলি এলাকাটি আগে মিডলসেক্স ও বাকিংহামশায়ার কাউন্টির অন্তর্গত ছিল, এবং এখানকার অনেক বাসিন্দা এখনও এই এলাকাকে মিডলসেক্স কাউন্টির অন্তর্গত হিসাবে মনে করে। |
পূর্ব লন্ডন (East London) (ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড এফসি, ওয়েস্টফিল্ড স্ট্র্যাটফোর্ড সিটি, কুইন এলিজাবেথ অলিম্পিক পার্ক, সিটি বিমানবন্দর) এই শহরতলি এলাকাটি আগে এসেক্স কাউন্টির অন্তর্গত ছিল। |
রিচমন্ড-কিউ (Richmond-Kew) (টুইকেনহাম স্টেডিয়াম, ন্যাশনাল আর্কাইভস, বুশি পার্ক, রয়েল বোটানিক গার্ডেন্স, রিচমন্ড পার্ক) এখানে টেমস নদীর ধারে আধা-গ্রাম্য পরিবেশ বিরাজ করে। এখানে অনেক বড় অভিজাত বাসস্থান ও উদ্যান এলাকা রয়েছে। |
জানুন
সম্পাদনা
ইতিহাস
সম্পাদনাব্রোঞ্জ যুগ থেকে লন্ডনের এলাকায় বিভিন্ন বসতি গড়ে উঠেছিল। ৪৩ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা ব্রিটেন জয় করে সেখানে "লন্দিনিউম" (Londinium) নামক একটি শহর গড়ে তুলেছিল, যা আধুনিক লন্ডনের ভিত্তি। ৪১০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনে রোমান শাসন শেষ হয়ে যাওয়ার পর লন্ডনের অবনতি ঘটেছিল। পরে ব্রিটেনে অ্যাংলো-স্যাক্সন ও নর্স জাতির আবির্ভাবের ফলে ঐ শহরের ক্রমোন্নতি হয়েছিল, এবং এটি মধ্যযুগের এক অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ১০৬৬ সালে উইলিয়ামের নেতৃত্বে নরম্যানরা ইংল্যান্ড আক্রমণ করেছিল এবং ইংল্যান্ড জয়ের পর তারা টাওয়ার অফ লন্ডন তৈরি করেছিল। ওয়েস্টমিনস্টারে উইলিয়ামকে ইংল্যান্ডের রাজা হিসাবে অভিষেক করা হয়েছিল।
ইংল্যান্ড যত ইউরোপ ও বিশ্বে প্রাধান্য লাভ করতে লেগেছিল, তত লন্ডনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে লেগেছিল, এবং এটি সংস্কৃতি, প্রশাসন ও শিল্পের কেন্দ্রতে পরিণত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের নবজাগরণের সময় থেকে লন্ডন নাটকের সাথে জড়িত এবং শেক্সপিয়ারের মতো নাট্যসাহিত্যিকরা লন্ডনে বসবাস করতে লেগেছিলেন। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেন সর্বপ্রধান সামুদ্রিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল এবং এটি বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়েছিল। এর ফলে লন্ডন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ও প্রভাবকে আকর্ষিত করেছিল এবং এটি বহু বছর ধরে বিশ্বের বৃহত্তম শহর ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান যুদ্ধবিমানগুলো লন্ডনের উপর বোমাবর্ষণ করেছিল এবং যুদ্ধের পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবনতি ঘটেছিল। তা সত্ত্বেও লন্ডন এক অন্যতম বৈশ্বিক শহর হিসাবে পরিচিত এবং এটি সংস্কৃতি, বাণিজ্য ও শিক্ষার বৈশ্বিক কেন্দ্র। বর্তমানে লন্ডন যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম শহর, দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্মিংহামের চেয়ে আটগুণ বড় এবং লন্ডন যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের ধারক ও বাহক। এটি যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ অংশ, যার ফলে এটি বহুসাংস্কৃতিক শহরে পরিণত হয়েছে।
সিটি ও ওয়েস্টমিনস্টার
সম্পাদনাঐতিহাসিকভাবে লন্ডন দুটি শহর থেকে উদ্ভূত: বাণিজ্যিক শহর ও রাজধানী শহর। এর মধ্যে বাণিজ্যিক শহর সিটি অফ লন্ডন (City of London) ঘনবসতিপূর্ণ এবং এখানে একটি মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় শহরের সমস্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে: প্রাচীর, দুর্গ (টাওয়ার অফ লন্ডন), ক্যাথিড্রাল (সেন্ট পলস), অর্ধ-স্বাধীন নগর প্রশাসন, বন্দর এবং বাণিজ্যপথের জন্য সেতু (লন্ডন ব্রিজ)।
সিটি অফ লন্ডন থেকে প্রায় এক ঘণ্টা উজানে নদীবাঁকে রয়েছে ঐতিহাসিক রাজধানী শহর ওয়েস্টমিনস্টার (Westminster)। এখানে রাজ্যাভিষেকের জন্য একটি গির্জা (ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি) সহ বিভিন্ন প্রাসাদ রয়েছে। এর মধ্যে ওয়েস্টমিনস্টার প্রাসাদ যুক্তরাজ্যের সংসদের সভাস্থল এবং বাকিংহাম প্রাসাদ রাজার সরকারি নিবাস। এই দুই প্রাসাদ "স্ট্র্যান্ড" (Strand) নামক একটি রাস্তা দ্বারা সংযুক্ত।
লন্ডন পশ্চিম ও পূর্ব উভয়দিকে বেড়ে উঠেছিল। সিটি অফ লন্ডনের পশ্চিমের অংশ একদা অন্যতম কৃষিজমি ছিল, যেমন কোভেন্ট গার্ডেন ও সোহো। পূর্বদিকের অংশ সমতল, জলা ও সস্তা ছিল এবং এটি সস্তার বাসস্থান ও শিল্পের এবং পরবর্তীকালে ডকের জন্য উপযুক্ত ছিল।
এই হিসাবে আধুনিক লন্ডন একটি দ্বিকেন্দ্রিক শহর এবং এই দুই কেন্দ্রের মধ্যবর্তী অংশ বিভ্রান্তিকরভাবে "ওয়েস্ট এন্ড" (West End) নামে পরিচিত, যার আক্ষরিক অর্থ "পশ্চিম প্রান্ত"।
পর্যটন তথ্য
সম্পাদনা- ভিজিট লন্ডন (Visit London)। শহরের পর্যটন ওয়েবসাইট।
- সিটি অফ লন্ডন ইনফরমেশন সেন্টার (City of London Information Centre), সেন্ট পলস চার্চইয়ার্ড (সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের কাছেই), ☎ +৪৪ ২০ ৭৩৩২ ৩৪৫৬। সোম–শনি ৯:৩০ পূর্বাহ্ণ–৫:৩০ অপরাহ্ণ, রবি ১০:০০ পূর্বাহ্ণ–৪:০০ অপরাহ্ণ। মধ্য লন্ডনের পর্যটন তথ্যের একমাত্র নিরপেক্ষ, মুখোমুখি উৎস।
তবে যুক্তরাজ্য বা ইংল্যান্ডের পর্যটন তথ্যের জন্য কোনো দপ্তর নেই।
ভাষা
সম্পাদনাইংরেজদের দেশের অন্তর্গত হওয়ার জন্য লন্ডনের প্রধান ভাষা ইংরেজি। তবে এখনকার বাচনভঙ্গি অঞ্চলভেদে ভিন্ন। বাংলাদেশ ও ভারতসহ ব্রিটেনের বিভিন্ন প্রাক্তন উপনিবেশে যে ইংরেজি উচ্চারণ শেখানো হয়, সেটি রিসিভড প্রনানসিয়েশন (Received Pronunciation বা RP) বা কিংস/কুইন্স ইংলিশ (King's/Queen's English) নামে পরিচিত, যা ওয়েস্টমিনস্টার অঞ্চলের উচ্চবিত্তদের উপভাষা। আবার, ইস্ট এন্ড অঞ্চলের শ্রমজীবীদের মধ্যে ককনি (Cockney) উপভাষা প্রচলিত, যা রিসিভড প্রনানসিয়েশনের থেকে অনেকটাই আলাদা। এছাড়া প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বিভিন্ন অভিবাসীদের বাসস্থান হিসাবে লন্ডনের কমবয়সীদের মধ্যে মাল্টিকালচারাল লন্ডন ইংলিশ (Multicultural London English বা MLE) চালু হয়ে গিয়েছে। যাইহোক, লন্ডনের বেশিরভাগ বাসিন্দা আপনার ইংরেজি বুঝতে পারবেন, তবে শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে আলোচনার সময় তাঁকে আস্তে আস্তে করে কথা বলার অনুরোধ করবেন।
প্রবেশ
সম্পাদনাআকাশপথে
সম্পাদনাবিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় লন্ডনগামী বিমানের সংখ্যা অনেক বেশি। এখানে ৬টি বিমানবন্দর রয়েছে (লন্ডনের সমস্ত বিমানবন্দরের জন্য আইএটিএ কোড LON আইএটিএ)ː
- হিথরো বিমানবন্দর (Heathrow Airport, LHR আইএটিএ)
- গ্যাটউইক বিমানবন্দর (Gatwick Airport, LGW আইএটিএ)
- স্ট্যানস্টেড বিমানবন্দর (Stansted Airport, STN আইএটিএ)
- লুটন বিমানবন্দর (Luton Airport, LTN আইএটিএ)
- সিটি বিমানবন্দর (City Airport, LCY আইএটিএ)
- সাউথএন্ড বিমানবন্দর (Southend Airport, SEN আইএটিএ)
লন্ডনের সমস্ত বিমানবন্দর ও নগরকেন্দ্রের মধ্যে গণপরিবহন সংযোগ রয়েছে, যার মধ্যে ট্রেন, টিউব ও বাস হচ্ছে সবচেয়ে দ্রুত মাধ্যম। ভ্রমণ পরিকল্পনা করার সময় বিমানবন্দর থেকে গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য প্রচুর সময় রাখুন।
বিমানে করে লন্ডনের একটি বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পর অন্য একটি বিমানবন্দর থেকে বিমান ধরতে হলে লন্ডন দিয়ে যাওয়ার জন্য প্রচুর সময় রাখুন। এটি যথেষ্ট সময় ব্যয় করে এবং আপনাকে একাধিকবার ট্রেন বদল করতে হবে।
হিথরো
সম্পাদনাগ্যাটউইক
সম্পাদনা2 গ্যাটউইক বিমানবন্দর (Gatwick Airport, LGW আইএটিএ)। লন্ডনের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। এটি দুটি টার্মিনাল রয়েছে: "নর্থ টার্মিনাল" ও "সাউথ টার্মিনাল"। মূলত ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্য থেকে আপনি গ্যাটউইক বিমানবন্দরে পৌঁছতে পারেন।
স্ট্যানস্টেড
সম্পাদনা3 স্ট্যানস্টেড বিমানবন্দর (Stansted Airport, STN আইএটিএ)। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা এবং যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন গন্তব্য থেকে বিমান রয়েছে।
লুটন
সম্পাদনা4 লুটন বিমানবন্দর (Luton Airport, LTN আইএটিএ)। লন্ডন থেকে ৩০ মা (৪৮ কিমি) দূরে অবস্থিত। ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্যে থেকে বিমান রয়েছে, বিশেষ করে দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপের ছোট শহর থেকে।
সিটি
সম্পাদনা5 সিটি বিমানবন্দর (City Airport, LCY আইএটিএ)। ক্যানারি হোয়ার্ফ থেকে ৩.৫ মা (৫.৬ কিমি) দূরে অবস্থিত। ইউরোপের অন্যান্য প্রধান শহর থেকে বিমান পরিষেবা রয়েছে।
সাউথএন্ড
সম্পাদনা6 সাউথএন্ড বিমানবন্দর (Southend Airport, SEN আইএটিএ)। ইউরোপের খুব সীমিত সংখ্যক গন্তব্য থেকে বিমান পরিষেবা রয়েছে।
ঘুরে দেখুন
সম্পাদনাদেখুন
সম্পাদনালন্ডন একটি বিশাল শহর এবং এখানকার সমস্ত দর্শনীয় স্থান ঘুরতে গেলে এমনকি এক মাসের পরিকল্পনাও যথেষ্ট নয়। এখানকার সমস্ত আকর্ষণকে বিভাগ নিবন্ধে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এবং নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ দেওয়া হয়েছে।
ল্যান্ডমার্ক
সম্পাদনা- বাকিংহাম প্রাসাদ (Buckingham Palace)। লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টারে অবস্থিত রাজপ্রাসাদ। কেবল গ্রীষ্মের মাসে পর্যটনের জন্য খোলা থাকে, তবে খোলা না থাকলেও বাইরে থেকে আপনি অবশ্যই এটি দেখে আসুন।
- লন্ডন আই (London Eye)। টেমস নদীর সাউথ ব্যাংকে অবস্থিত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম নাগরদোলা। এখন থেকে লন্ডনের চিত্তাকর্ষক দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
- সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল (St. Paul's Cathedral)। নগরকেন্দ্রের অন্যতম আকর্ষণ। ১৬৬৬ সালে লন্ডনে এক মহা অগ্নিকাণ্ডের ফলে এটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং স্যার ক্রিস্টোফার রেন এর পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। এখান থেকে পার্শ্ববর্তী এলাকার এক সুন্দর দৃশ্য পাওয়া যায়।
- টাওয়ার ব্রিজ (Tower Bridge)। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত সেতু, যা নগরকেন্দ্রের কাছেই অবস্থিত। টাওয়ার ব্রিজ এগজিবিশনের (Tower Bridge Exhibition) মাধ্যমে আপনি সেতুটির ভিতরে প্রবেশ করতে পারেন।
- ওয়েস্টমিনস্টার এলাকায় ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি (Westminster Abbey) ও ওয়েস্টমিনস্টার প্রাসাদ (Palace of Westminster)। ওয়েস্টমিনস্টার প্রাসাদ যুক্তরাজ্যের সংসদের সভাস্থল এবং ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। এর সঙ্গে যুক্ত বিখ্যাত ঘড়ি স্তম্ভটি বিগ বেন (Big Ben) নামে পরিচিত, যদিও এর সরকারি নাম এলিজাবেথ টাওয়ার (Elizabeth Tower)। প্রাসাদটি কেবল সংসদের বিতর্কসভা দেখার জন্য উন্মুক্ত। জুলাই থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে ভবনের ট্যুর প্রোগ্রাম চালু থাকে।
- দ্য শার্ড (The Shard)। সাউথ ব্যাংকে অবস্থিত ত্রিভুজের মতো দেখতে একটি ফিউচারিস্টিক গগনচুম্বী অট্টালিকা। এটি যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ ভবন। ৭৩তম তলে (72nd floor) ভিউয়িং ডেক রয়েছে, যা জনগণের জন্য উন্মুক্ত। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে টিকিট কাটতে হবে।
উদ্যান
সম্পাদনালন্ডনের বিভিন্ন উদ্যান একত্রে এই শহরের "সবুজ ফুসফুস" (green lungs) নামে পরিচিত, যার মধ্যে হাইড পার্ক (Hyde Park), সেন্ট জেমস পার্ক (St. James Park) ও রিজেন্ট পার্ক। বেশিরভাগ বড় উদ্যানগুলো একদা রাজকীয় ভূসম্পত্তি ছিল এবং এখানকার শিকারস্থানগুলো এখনও রাজশক্তির অধীনে।
- হাইড পার্ক ও পার্শ্ববর্তী কেনসিংটন গার্ডেন্স মিলে মধ্য লন্ডনে এক বিশাল উন্মুক্ত জায়গা গঠন করে।
- রিজেন্ট পার্ক মধ্য লন্ডনের উত্তরে এক সুন্দর উন্মুক্ত উদ্যান, যার উত্তরের দিকেই রয়েছে লন্ডন চিড়িয়াখানা।
করুন
সম্পাদনালাইভ সঙ্গীত
সম্পাদনাথিয়েটার
সম্পাদনাওয়েস্ট এন্ড এলাকা, বিশেষ করে লেস্টার স্কোয়ার, কোভেন্ট গার্ডেন, শাফটসবরি অ্যাভিনিউ ও হেমার্কেট বিশ্বের অন্যতম থিয়েটার গন্তব্য।
অন্যান্য
সম্পাদনা- লন্ডনের রয়েল পার্কগুলো দিয়ে হাঁটা: প্যাডিংটন স্টেশন থেকে কেনসিংটন গার্ডেন্স, হাইড পার্ক, গ্রিন পার্ক (বাকিংহামের পাশ দিয়ে) ও সেন্ট জেমস পার্ক হয়ে ট্রাফালগার স্কোয়ার, টেমস নদী ও ওয়াটারলু স্টেশন। হেঁটে এই পথ অতিক্রম করতে অর্ধেক দিন লাগবে, এবং সেখানে যাত্রাপথে খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত থাকবে।
- ফুটবল দেখা: লন্ডনে কয়েক ডজন পেশাদারি ফুটবল ক্লাব রয়েছে। ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম (Wembley Stadium) ইংল্যান্ডের জাতীয় স্টেডিয়াম এবং এখানে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা (যেমন ইউরো ও ফিফা বিশ্বকাপ) এবং ক্লাব প্রতিযোগিতার ফাইনাল খেলা (যেমন এফএ ক্লাব ও লিগ ক্লাব) আয়োজিত হয়।
- ক্রিকেট দেখা: লন্ডনের ওভাল ও লর্ডস স্টেডিয়ামে টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেট খেলা হয়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় দলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা দেখা অত্যন্ত আনন্দদায়ক।
শিখুন
সম্পাদনাইংরেজি
সম্পাদনালন্ডনে ভ্রমণ করার সময় ইংরেজি ভাষাতে অসুবিধা থাকলে চিন্তার কোনো দরকার নেই। লন্ডনেই আপনি নিজের মৌখিক ও লিখিত ইংরেজিকে (Spoken English ও Written English) আরও উন্নত করতে পারেন।