দু’টি পাতা একটি কুড়ির দেশ সিলেট। হযরত শাহজালাল (র.) এর পুণ্যভুমি এই সিলেট বিভাগের একটি জেলার নাম হচ্ছে মৌলভীবাজার। আর এই মৌলভীবাজারের একটি ঐতিহ্যবাহী উপজেলার হচ্ছে বড়লেখা। প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয্যে ভরপুর এই বড়লেখায় মাধবকুন্ডের অবস্থান।

পাথারিয়া পাহাড়ের গাঁ বেয়েই মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের সৃষ্টি। দৈর্ঘ্য প্রায় তিরাশি মিটার উচু পাথরের টিলার ওপর থেকে অবিরাম গতিতে ঝর্ণা আছড়ে পড়ছে নিচে। প্রায় ১৮০ ফুট উপর হতে অবিরাম গতিতে জলরাশি নিচে পতিত হওয়ার ফলে নিচে সৃষ্টি হয়েছে একটি কুন্ড। আর এই কুন্ডের প্রবাহমান বারিষার মতো স্রোতধারা শান্তির বারিধারার মতো মাধবছড়া দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

মাধবকুন্ডের নাম নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন, শ্রীহট্রের রাজা গঙ্গাধ্বজ ওরফে গোধ্বর্ন পাথারিয়া পাহাড়ে একটি বিশ্রামাগার নির্মান করতে গেলে সেখানে মাটির নিচে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় একজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পান। তারপর তিনি উক্ত সন্ন্যাসীর পদ বন্দনা ও স্তুতি আরম্ভ করেন। সন্ন্যাসী নানা উপদেশসহ তাকে ঐকুন্ডে মধুকৃষস্না ত্রয়োদশী তিথিতে বিসর্জন দিতে নির্দেশ দেন। রাজা গঙ্গাধ্বজ সন্ন্যাসীর কথামতো তাকে ঐ কুন্ডে বিসর্জিত করা মাত্রই তিনবার মাধব ! মাধব !! মাধব !!! দৈব্যবানী উচ্চারিত হয়। ধারণা করা হয় এই দৈব্যবানী থেকেই মাধবকুন্ড নামের উৎপত্তি।

কীভাবে যাবেন?

সম্পাদনা

লেখার শুরুতে আমরা জেনেছি এটি সিলেট বিভাগের একটি ঝর্না। যদি আপনি শুধু মাত্র মাধবকুন্ড দেখতে আসেন (অন্য বিভাগ থেকে) এবং আপনার বাহন যদি বাস অথবা ট্রেন হয় তবে সিলেট আসার দরকার নাই। যদি বাসে আসেন তবে সরাসরি মৌলভীবাজার আসুন। আর যদি ট্রেনে আসেন তবে সিলেট না গিয়ে কুলাউড়া স্টেশনে নেমে পড়ুন। অবশ্য বিমানে আসলে আপনাকে সিলেট হয়ে আসতে হবে যেহেতু আর কোন বিমান বন্দর নাই।

সরাসরি মাধবকুন্ড: মিশন কাঠালতলী


যদি আপনি বাসে আসেন তবে মৌলভীবাজার নেমে টমটম অথবা রিক্সা নিয়ে চাদনীগাট চলে যাবেন। ওখানে বড়লেখার বাস পাবেন। লোকাল এবং বিরতীহীন উভয়ই পাওয়া যায়। রিকোমেন্ড করি বিরতীহীনে আসতে। বিরতীহীনে মৌলভীবাজার থেকে কাঠালতলী পযর্ন্ত আসবেন। সময় লাগবে ২ ঘন্টার মতো। আর যদি সি. এন. জিতে করে আসতে চান তবে সরাসরী বড়লেখাগামী সি.এন.জি পাওয়া দুষ্কর। এক্ষেত্রে আপনাকে কুলাউড়াগামী সি.এন.জি উঠতে হবে। কুলাউড়ায় আসার পর আবারো বড়লেখাগামী সি.এন.জিতে করে কাঠালতলীতে এসে নামতে হবে।

যদি আপনি সিলেটগামী ট্রেনে আসেন তবে কুলাউড়ার স্টেশনে নেমে পড়ুন। স্টেশনের পাশেই সি.এন.জি পাবেন বড়লেখাগামী। যেকোন সি.এন.জি করে চলে আসুন কাঠালতলী। কুলাউড়া থেকে কাঠালতলীতে সি.এন.জিতে যেতে সময় লাগবে ৪৫ মিনিট।

সিলেট হয়ে মাধবকুন্ড


আর যদি আপনি সিলেট হয়ে মাধবকুন্ডে আসতে চান তথা আপনার ট্যুর প্লান বড় থাকে তবে এই লেখাটি আপনার জন্য। সিলেট থেকে মাধবকুন্ড যাবার জন্য বাস এবং ট্রেন দুটি মাধ্যমই আপনি ব্যবহার করতে পারেন। বাস হলে সিলেট কদমতলীতে থেকে বড়লেখাগামী লোকাল এবং বিরতীহীন গাড়ি পাবেন। যদি বাসে আসতে চান তবে অবশ্যেই বিরতীহীন বাসে আসবেন। ভুলেও লোকাল বাসে চড়ার দরকার নাই। যদি বিরতীহীন বাস না পান তবে কদমতলী থেকে রিক্সা নিয়ে চলে যান নতুন ব্রিজের নিচে। ওখান থেকে বিয়ানীবাজারগামী সি.এন.জি পাবেন। তারপর বিয়ানীবাজার গিয়ে বড়লেখাগামী সি.এন.জিতে করে চলে যান বড়লেখা। বাস কিংবা সি.এন.জিতে করে বড়লেখায় আসার পর আপনাকে আবারো সি.এন.জিতে করে যেতে হবে কাঠালতলী। চাইলে আপনি বড়লেখা থেকেও সি.এন.জি রিজার্ভ করে মাধবকুন্ডে যেতে পারেন।

এবার আসি ট্রেনের কথায়। সিলেট থেকে চাইলে আপনি ট্রেনে করেও যেতে পারেন বড়লেখা। তবে এক্ষেত্রে আপনাকে কুলাউড়ায় নামতে হবে। কুলাউড়ায় নেমে বড়লেখাগামী সি.এন.জি করে চলে আসুন কাঠালতলী।


কাঠালতলী টু মাধবকুন্ড


আমাদের ফাইনাল যাত্রা হচ্চে কাঠালতলী টু মাধবকুন্ড। কাঠালতলী বাজারে নেমে অনেক অনেক সি.এন.জি পাবেন যারা বড়খলা বা স্থানীয় নাম খলাগাউ পযর্ন্ত যাবে। যদি আপনি ভেঙ্গে ভেঙ্গে খরচ কমিয়ে যেতে চান তবে তাতে করে যেতে পারেন। অন্যথায় আপনাকে রিজার্ভ করে নিতে হবে। মনে রাখবেন কাঠালতলী খেকে সরাসরি কোন গাড়ি মাধবকুন্ড যায়না যদি না আপনি রিজার্ভ করে নেন। তো বড়খলা বাজার থেকে আপনি যদি মাধবকুন্ড যাবার প্ল্যান করেন তবে আর গাড়ির দরকার নাই। রিক্সা নিয়েই পাহাড় এবং চা-বাগানের মাঝে হারিয়ে যান। উল্লেখ্য যে, রিক্সাটা রিজার্ভ করে নিতে হবে। রিক্সা যদি ছেড়ে দেন তবে ফেরত আসতে গাড়ি পাওয়াটা সময় সাপেক্ষ হয়ে যাবে।

ফ্লোচার্ট

সম্পাদনা

আপনার এরিয়া থেকে:

ট্রেন: আপনার স্টেশন - কুলাউড়া - সি.এন.জিতে কাঠালতলী - সি.এন.জিতে খলাগাউ - রিক্সায় মাধবকুন্ড

বাস: আপনার এরিয়া - মৌলভীবাজার - বাসে কাঠালতলী - সি.এন.জিতে খলাগাউ - রিক্সায় মাধবকুন্ড

সিলেট থেকে:

বাস: কদমতলী - বড়লেখা - সি.এন.জিতে কাঠালতলী - সি.এন.জিতে খলাগাউ - রিক্সায় মাধবকুন্ড

ট্রেন: সিলেট স্টেশন - কুলাউড়া - সি.এন.জিতে কাঠালতলী - সি.এন.জিতে খলাগাউ - রিক্সায় মাধবকুন্ড

সি.এন.জি: নতুন ব্রিজের নিচ থেকে -বিয়ানিবাজার - বিয়ানিবাজার থেকে সি.এনজিতে বড়লেখা - সি.এন.জিতে কাঠালতলী - সি.এন.জিতে খলাগাউ - রিক্সায় মাধবকুন্ড

কখন যাবেন

সম্পাদনা

অনেকে মাধবকুন্ড যাবার জন্য ভুল টাইম সিলেক্ট করেন। শীতকাল যদিও ভ্রমনের জন্য আদর্শ সময় কিন্তু ঝর্না দেখার জন্য সেটা প্রযোজ্য নয়। পানি দেখতে পানির সিজন তথা বর্ষাকাল হচ্ছে উপযুক্ত সময়। সবুজ প্রকৃতির সাথে মিতালি করতে এবং ঝর্ণার কুয়াশায় সিক্ত হতে তাই বর্ষায় আসুন মাধবকুন্ড। ঝর্ণায় তখন প্রচুর পানি পাবেন। চেষ্টা করবেন দুপুরের দিকে যেতে। বিকাল হলে খুব তাড়াতাড়ি চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়।

কোথায় খাবেন

সম্পাদনা

সত্যি কথা বলতে গেলে পুরো বড়লেখায় ভাল খাবারের রেস্তোরাঁ খুজে পাওয়া দুষ্কর। হতাশ হবার কারন নাই। যেহেতু আপনি ভ্রমনে যাচ্ছেন খাবার খেতে নয় সেহেতু যা আছে তা দিয়ে মুঠামুঠি চালিয়ে নিতে পারবেন।তবে মনে রাখবেন খাবারের দাম এবং মান কোনটাই কিন্তু সহনীয় নয়। ভাল হয় যদি আপনি খাবার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেন। চাইলে সিলেট কিংবা কুলাউড়া উভয় জায়গা থেকেও আপনি খাবার কিনে নিতে পারেন।

আশেপাশের দর্শনীয় স্থান

সম্পাদনা

পাহাড়, চা-বাগান, খাসিয়াপুজ্ঞি: মাধবকুন্ড যাবার বোনাস হিসাবে আপনি বেশ কিছু জিনিস এমনিতেই দেখতে পারবেন। তার মধ্যে পাহাড়, চা-বাগান, খাসিয়াপুজ্ঞি অন্যতম। এসব জায়গায় আপনি অনায়াসে বেড়াতে পারবেন। তবে এই সব জায়গায় বেড়াতে গেলে আপনি ভাল তো জগৎ ভার এই নীতিটা আপনাকে মেনে চলতে হবে। যদি আপনি নিজ থেকে কোন সমস্যা তৈরী না করেন তবে কোন সমস্যাায় পতিত হবার চান্স নাই বললেই চলে।

পরিকুন্ড: যদি আপনি বর্ষাকালে মাধবকুন্ড যান তবে চেষ্টা করবেন অবশ্যই এবং অবশ্যই পরিকুন্ডটাও দেখে আসার। দুটো ঝর্ণার দুই রকম রুপ।মুগ্ধ হতে বাধ্য। পরিকুন্ড যাবার রাস্তা নিয়ে চিন্তিত হবার কোন কারন নাই। স্থানীয় যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই অনায়াসে যেতে পারবেন সেখানে।

হাকালুকি: বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকির বেশির ভাগ অংশের অবস্থান বড়লেখা উপজেলায়। আর তাই মাধবকুন্ড দেখার পাশাপাশি বিকাল বেলা হাকালুকি সৌর্ন্দয্য উপভোগ করতে পারেন। হাকালুকি যাবার জন্য আপনাকে স্থানীয় সি.এন.জি রিজার্ভ করে নিতে হবে। কাঠালতলী থেকে হাকালুকি যেতে সময় লাগবে ১ থেকে ১.৩০ ঘন্টার মতো।


আগর-আতর: সূদুর মধ্যপাচ্যের আগর-আতরের অন্যতম যোগানদাতা বাংলাদেশের আগর-আতরের রাজধানী খ্যাত বড়লেখার সুজানগর গ্রামটিও ঘুরে দেখতে পারেন যদি আপনার হাতে পযার্প্ত সময় থাকে। কাঠালতলী থেকে সুজানগর যেতে আপনাকে সি.এন.জি নিয়েই যেতে হবে।

বেকির লেক: প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয্যে ভরপুর বড়লেখার উপজেলার দক্ষিণ ভাগের বেকির লেকটিও হতে পারে আপনার ভ্রমনে পরবর্তী স্থান। সৌর্ন্দয্যের ক্ষেত্রে কোন ভাবেই এটা শ্রীমঙ্গলের মাধবপুর লেকের চাইতে কম নয়। যেতে চাইলে সি.এন.জি নিয়েই যেতে হবে সেখানে।

বিষয়শ্রেণী তৈরি করুন