পুরী (ওড়িয়া: ପୁରୀ), অন্যান্য নাম জগন্নাথ পুরী ও পুরুষোত্তম পুরী, হচ্ছে ভারতের ওড়িশা রাজ্যের সমুদ্রধারে অবস্থিত একটি হিন্দু তীর্থস্থান ও পর্যটন কেন্দ্র। বিভিন্ন কারণে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের লোকেরা পুরীতে এসে ভিড় করে, সে জগন্নাথ ধামে ভগবান দর্শনের জন্যই হোক কিংবা সমুদ্র ধারে মস্তির জন্যই হোক।
জানুন
সম্পাদনাপুরী হচ্ছে হিন্দুদের পবিত্র চারধাম তীর্থস্থানের মধ্যে একটি, এবং সেখানে অবস্থিত জগন্নাথ মন্দির ওড়িশার কলিঙ্গ স্থাপত্যকলার একটি নিদর্শন। এছাড়া এখানে ৮ কিমি দীর্ঘ সৈকত আছে, যেখান থেকে বঙ্গোপসাগরের সুন্দর দৃশ্য পাওয়া যায়।
ভাষা
সম্পাদনাওড়িশার বাকি জায়গার মতো পুরীর বেশিরভাগ স্থানীয়রা ওড়িয়া ভাষায় কথা বলেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যক্তিদের উপস্থিতির জন্য এখানে বাংলা সহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা প্রচলিত। অনেক দোকান ও হোটেলের নির্দেশিকায় ইংরেজির ও ওড়িয়ার সঙ্গে বাংলা ভাষাও ব্যবহৃত হয়। বেশিরভাগ স্থানীয়রা হিন্দি ও বাংলা দুটোই বুঝতে পারবেন, বাংলা না বুঝতে পারলে আপনি হিন্দি বা ওড়িয়া ভাষা ব্যবহার করতে পারেন।
প্রবেশ
সম্পাদনাআকাশপথে
সম্পাদনাপুরীর নিকটতম বিমানবন্দর ভুবনেশ্বরে অবস্থিত, যা পুরী থেকে ৬০ কিমি দূরে অবস্থিত। সেখান থেকে আপনি বাস বা ট্রেন ধরতে পারেন।
রেলপথে
সম্পাদনারেলপথের দ্বারা পুরী ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে সংযুক্ত। হাওড়া, নতুন দিল্লি, আহমেদাবাদ ইত্যাদি শহর থেকে ট্রেন পুরীতে যায়। 1 পুরী রেলওয়ে স্টেশন শহরের মাঝখানে অবস্থিত এবং বেশিরভাগ হোটেলের কাছেই। ট্রেনে আসার সময় উপদেশের জন্য আপনি ওড়িশা স্টেট ট্যুরিস্ট কাউন্টারে যেতে পারেন।
পুরীগামী কিছু গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন:
- শালিমার ও সাঁতরাগাছি থেকে: ধৌলি এক্সপ্রেস, শ্রী জগন্নাথ এক্সপ্রেস
- শিয়ালদহ থেকে: দুরন্ত এক্সপ্রেস
- হাওড়া থেকে: বন্দে ভারত এক্সপ্রেস, শতাব্দী এক্সপ্রেস, সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস
ঘুরে দেখুন
সম্পাদনাআপনি সাইকেল রিকশা, অটোরিকশা কিংবা বৈদ্যুতিক রিকশা দিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন, কিন্তু বেরোনোর আগে আপনাকে এদের ভাড়ার সঙ্গে রাজি হতে হবে। শুরুতে কোনো ভয়ানক অভিজ্ঞতা এড়ানোর জন্য আপনাকে ঐ ভাড়াকে দুবার নিশ্চিত করুন, কারণ এরা কাঙ্ক্ষিত দামের বেশি টাকা আদায় করার চেষ্টা করবে। সিটি রোডের কিছু জায়গায় আপনি রয়েল এনফিল্ড মোটরসাইকেল ভাড়া করতে পারেন। এটা খুব ভাল যদি আপনি উপকূল বরাবর কোণার্ক সূর্য মন্দিরে যেতে চান। সাইকেল রিকশার সর্বোচ্চ ভাড়া ₹৫২০।
দেখুন ও করুন
সম্পাদনা- 1 পুরীর সৈকত। পুরীর ৮ কিমি দীর্ঘ সৈকত, এবং সার্ফিঙের জন্য উপযুক্ত। সৈকতটি সোনার বালি দিয়ে মোড়া। পূর্ণিমার সময় ঢেউ আরও উত্তাল হয়। উট ও ঘোড়ার উপর চড়ার ব্যবস্থা আছে। ৪৫ মিনিট ধরে সেখানে বসার ব্যবস্থা আছে। সৈকতের সুন্দর দৃশ্য বজায় রাখার জন্য দয়া করে একে নোংরা করবেন না। সমুদ্রে খেলা করতে আপনি অভ্যস্ত না হলে আপনি সমুদ্র থেকে কয়েক মিটার দূর থেকে সমুদ্রের দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন, তবে এর ঢেউ আপনার পায়ের কাছে এলে একে যেন ভয় করবেন না।
মন্দির
সম্পাদনা- 2 গুণ্ডিচা মন্দির (ଗୁଣ୍ଡିଚା ମନ୍ଦିର)। জগন্নাথ মন্দির থেকে রথযাত্রার গন্তব্য। প্রত্যেক বছর এই মন্দিরে সাতদিনের জন্য জগন্নাথ ও তাঁর ভাইবোন থাকেন ও পরে উল্টো রথে করে তাঁরা মূল মন্দিরে ফিরে যান। মন্দিরে প্রবেশের জন্য কোনো টাকা দিতে হয় না।
- 3 জগন্নাথ মন্দির (ଜଗନ୍ନାଥ ମନ୍ଦିର)। এটি হচ্ছে হিন্দুদের পবিত্র চারধাম মন্দিরের একটি। একাদশ শতাব্দীতে নির্মিত এই মন্দির থেকে বিশ্ববিখ্যাত রথযাত্রা আরম্ভ হয়। কেবলমাত্র হিন্দুরা প্রবেশ করতে পারবেন। জুতো, ক্যামেরা, মোবাইল ও চামড়ার সামগ্রী মন্দির চত্বরে নিষিদ্ধ, আপনি এগুলি নিকটবর্তী জুতো স্ট্যান্ডে (অনেকসময় "জুতা ষ্টাণ্ড" লেখা থাকে) জমা করুন। মূল মন্দিরে ভিড় হইতে সাবধান। এই মন্দির চত্বরটি বিশাল বড় এবং এর সঙ্গে অনেক ভালোমন্দ গল্প জড়িয়ে আছে। সাধারণত পুরোহিত বা পাণ্ডাগণ এইসব গল্প আপনাদের শোনাবেন, যদিও এনারা প্রচুর টাকা আদায় করবেন। টাকার বিনিময়ে আপনি গর্ভগৃহে প্রবেশ করে ভগবানদের স্পর্শ করতে পারবেন।
ঘটনাসমূহ
সম্পাদনারথযাত্রা হচ্ছে পুরীর প্রধান উৎসব এবং এটি প্রতি বছর জুন–জুলাই করে পালিত হয়। প্রথম দিনে জগন্নাথ ও তাঁর ভাইবোন বলরাম ও সুভদ্রাকে জগন্নাথ মন্দির থেকে গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম দিনে তাঁদের রথে রাখা হয় এবং দ্বিতীয় দিন থেকে সাত দিনের জন্য তাঁরা গুণ্ডিচা মন্দিরে থাকেন। এর পর তাঁদের রথে করে মূল মন্দিরে নিয়ে আসা হয়, যা চলতি বাংলায় "উল্টো রথ" নামে পরিচিত। জগন্নাথ মন্দির ও গুণ্ডিচা মন্দিরের মধ্যবর্তী এলাকায় অত্যন্ত ভিড় হয়, সুতরাং এইসব সময়ে আপনি প্রস্তুত থাকুন।
কিনুন
সম্পাদনাপুরীর বিভিন্ন জায়গায় দোকান, হাট, বাজার ইত্যাদি বর্তমান, তবে এর মধ্যে স্বর্গদ্বার ও পুরীর সৈকত সবচেয়ে জনপ্রিয়। কেনার সামগ্রীর মধ্যে জগন্নাথের মূর্তি বা ছবি, জগন্নাথ মার্কা সামগ্রী, স্থানীয় তাঁতের বস্ত্র, স্থানীয় খাদ্য (আহার ও পানীয় দ্রষ্টব্য) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। স্থানীয় তাঁতের বস্ত্রের জন্য আপনি "ওড়িশা ষ্টেট হ্যাণ্ডলুম্" নামক দোকানগুলিতে ঢুঁ মারতে পারেন।
আহার ও পানীয়
সম্পাদনাপুরী "খাজা" মিষ্টান্নের জন্য বিখ্যাত, এবং বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে, এমনকি জগন্নাথের প্রসাদ হিসেবেও এটি পাওয়া যায়। নিম্নলিখিত রেস্তোরাঁ ছাড়াও "রাত্রিযাপন" অনুচ্ছেদে উল্লেখিত বিভিন্ন হোটেলের সঙ্গে রেস্তোরাঁ থাকে।
- 1 অসলি নৃসিংহ সুইটস, স্বর্গদ্বার। পুরী জুড়ে একাধিক মিষ্টির দোকানের নাম "নৃসিংহ সুইটস" রাখা হয়েছে, যার মধ্যে স্বর্গদ্বারের অসলি নৃসিংহ সুইটস হচ্ছে প্রাচীনতম। এর চারটি শাখা আছে।
- 2 গাঙ্গুরাম সুইটস, স্বর্গদ্বার (হ্যাণ্ডলুম্ গার্ডেনের সামনে)। পুরী জুড়ে একাধিক মিষ্টির দোকানের নাম "গাঙ্গুরাম সুইটস" রাখা হয়েছে, যার মধ্যে হ্যাণ্ডলুম্ গার্ডেনের সামনের গাঙ্গুরাম সুইটস হচ্ছে প্রাচীনতম। এর কোনো শাখা নেই।
- 3 দাদা বৌদির রেষ্টুরেণ্ট, স্বর্গদ্বার (ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ লাইব্রেরীর বিপরীতে)। কলকাতার জনপ্রিয় দাদা বৌদির রেষ্টুরেণ্টের পুরী শাখা।
রাত্রিযাপন
সম্পাদনাটীকা: কলকাতা ভিত্তিক অস্বাস্থ্যকর, দুর্নীতিবাজ ও একদম অবিশ্বস্ত হোটেল এড়ানোর জন্য কোনো অগ্রিম সংরক্ষণ ছাড়াই পুরীতে এসে হোটেল ভাড়া করাই ভাল।
কোনো ঘর ভাড়া করার সময় আপনি দয়া করে সুমদ্রমুখী ("সি-ফেসিং") ঘর ভাড়া করুন। সুমদ্রমুখী নয় এমন বাতানুকূল ঘরের থেকে একটি বাতানুকূল নয় এমন সুমদ্রমুখী ঘর অত্যন্ত ভাল। |
সাবধানে থাকুন
সম্পাদনাস্বর্গদ্বার বা নতুন পুরীর সস্তার হোটেল বা গেস্ট হাউসের ক্ষেত্রে নিজের সামগ্রীর প্রতি যত্ন রাখতে ভুলবেন না। রাত ৮টার পর সমুদ্রে না বেরোনোই ভাল। পুরীতে ভীষণ অসুস্থ হয়ে গেলে ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ হাসপাতালে যাওয়া ভাল কারণ পুরীর হাসপাতালগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের ও অপরিচ্ছন্ন। প্রয়োজন পড়লে হোটেল আপনার জন্য স্থানীয় ডাক্তারের ব্যবস্থা করবে।
সমুদ্রের ধারে জিভে জল গড়ানো খাবারের স্টল রয়েছে, যা মাছ, মাটন, মুরগির কাবাব, চপ ও কাটলেট বিক্রি করে। আপনি এসব খাবার থেকে দূরে থাকুন যদি আপনি পুরীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে না চান। এমনকি উচ্চ হজমশক্তির ভারতীয় পেটও সুস্বাদু কিন্তু অস্বাস্থ্যকর খাবার সহ্য করতে পারবে না এবং এরা আপনার পাচক ব্যবস্থাকে সর্বনাশ করে ছাড়বে। দরকার হলে হোটেল বা রেস্তোরাঁর খাবার খাবেন, তাও ভাল। ঐসব সমুদ্র বা রাস্তার ধারের "খাবারের" স্টল থেকে দশ হাত দূরে থাকুন।
যেকোনো মন্দিরের পাণ্ডাদের হইতে সাবধান। তাঁরা ভগবানের নামে আপনার পকেট থেকে নির্মমভাবে টাকা আদায় করবেন। তাঁরা অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং কোনো আইন এঁদের সাজা দিতে পারবে না। আপনি হিন্দু হলেও দয়া করে কোনো জাগ্রত মন্দিরের সবচেয়ে ভেতরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করবেন না। পাণ্ডাগণ বিনয়ী সেজে একই মন্দিরের যেখানে সেখানে অগুনতি ভগবানের পূজা বা সম্মানের জন্য আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, কিন্তু প্রত্যেক ভগবানের জন্য আলাদাভাবে আপনার কাছে টাকা চাইবেন। তাঁদের সঙ্গে তর্ক করে কোনো লাভ নেই। আপনি যদি একটু ধার্মিক বা কৌতুহলী হন, তবে কোনোরূপ কোলাহল না করে পাণ্ডাদের ₹১, ₹২, ₹৫, ₹১০ ইত্যাদি দিলে আপনি তাঁদের হাত থেকে রেহাই পাবেন।
বাঁদরদের থেকেও সাবধান। খাবার ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে তাদের প্রলুব্ধ করে তুলবেন না।
পরবর্তী গন্তব্য
সম্পাদনা- কোণার্ক (৫২ কিমি পূর্ব) — ঐতিহাসিক সূর্য মন্দির।
- চিল্কা হ্রদ (৫০ কিমি পশ্চিম) — ভারতের দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় হ্রদ এবং ভারতের ডলফিন দর্শনের অন্যতম কেন্দ্র।
- ভুবনেশ্বর (৬০ কিমি উত্তর) — ওড়িশার রাজধানী, একাধিক ঐতিহাসিক মন্দির ও নন্দনকানন চিড়িয়াখানা বর্তমান।